ভারতে সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলনের গোড়ার কথা


ভারতে সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলনের 
গোড়ার কথা-
--------------------------------------
করোনাকালের এক কঠিন দুঃসময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছি আমরা।চূড়ান্ত প্রতিকূলতার মধ্যেও ঐতিহাসিক মে দিবসের মধ্য দিয়ে শ্রমজীবীর বিজয় বার্তা নিয়ে মিলিত হয়েছে পৃথিবীর শ্রমিকশ্রেণীর অংশ হিসাবে এদেশে আমরাও। 

এই সময় শ্রমিকশ্রেণীর জীবন জীবিকার সামনে পৃথিবীজুড়েই নেমে এসেছে এক গাঢ় অমানিশা।ধনতন্ত্রের সংকট,বিশ্ব মন্দা ছিলই, এর সাথে করোনা মহামারী যুক্ত হয়ে নিরন্ন মানুষের হাহাকার দুনিয়াকে নতুন কিছু প্রশ্নের সামনে হাজির করেছে।বহু নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও এই দ্রোহকালে লালঝান্ডা ঊর্দ্ধে তুলে মানুষের পাশে থাকার শপথ আমাদের নিতেই হবে।শ্রমজীবীর অধিকারগুলি খর্ব করেই এ সময় ধনতন্ত্র তার তীব্র সংকট থেকে মুক্তি পেতে চাইবে। কাজেই ছাঁটাই, মজুরিহ্রাস, ১২ঘন্টার শ্রম দিবস,ওয়েজ ফ্রিজের মতো বহুমাত্রিক শোষনের ঘটনা চলতে থাকবে।বেকারী,বেরোজগারী,ক্ষুধা এক নিশ্চিত অনাহারে মৃত্যুর দিনলিপির পাল্টা জীবন সংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে হবে আমাদের শ্রমজীবীদের ঐক্যবদ্ধ করেই।
অপরদিকে পাশ্চাত্য শিক্ষা,ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি এবং রামমোহন বিদ্যাসাগরের হাতধরে ঊনবিংশ শতকে ভারতে মধ্যযুগীয় ভাবধারার বিরূদ্ধে আধুনিক চিন্তাধারা সূত্রপাত ঘটে। পরবর্তীকালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী সংগ্রামের অংশ হিসেবে স্বদেশী আন্দোলন ভারতীয় ধনিক গোষ্ঠীর মধ্যে দেশীয় শিল্প গড়ে তুলতে অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করে। দেশীয় কারখানা সহ ব্যাঙ্কিং,বিমা ব্যবস্থায় সর্বোচ্চ দেশীয় উদ্যোগ গড়ে ওঠে। এভাবে দেশীয় শিল্পের হাত ধরেই এদেশে শ্রমিকশ্রেণী ক্রমশ স্ফীত হয়ে ওঠে। তবে এই শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে কৃষি জীবনের পিছুটান, কুসংস্কার,বর্ণ,জাতিভেদের প্রভাব মুক্ত হবার সুযোগ তখনো সেভাবে ঘটেনি। কাজেই শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি ও চেতনা সৃষ্টিতে প্রতিবন্ধকতা থেকেই যায়।
শিল্প স্থাপনের প্রথম যুগে- কলকাতা,মুম্বাই, মাদ্রাজ,কানপুর,নাগপুর প্রভৃতি অঞ্চলে বহু কল কারখানা স্থাপিত হয়েছিল। 
এর পাশাপাশি গড়ে উঠেছিল শ্রমিকশ্রেণীকে মতাদর্শগত ভাবে পুষ্ট করার জন্য বিভিন্ন 
প্রতিষ্ঠান।যেমন -
#বাংলায় 1874 খ্রিস্টাব্দে "ভারত শ্রমজীবী" নামে একটি পত্রিকা প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রকাশক- শশীপদ ব্যানার্জি।
#অনুরূপভাবে 1898 খ্রিস্টাব্দে বোম্বাই থেকে "দীনবন্ধু" নামে আরেকটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। প্রকাশক- মেঘাজী লোখান্ডেও। 
#1880 খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় "বরানগর ইনস্টিটিউট"। এটি ছিল শ্রমিকদের প্রথম "নাইট স্কুল"।
#1890 খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় - "বম্বে মিলহ্যান্ডস্ অ্যাসোসিয়েসন "। তবে কোন ভাবেই এটি সংগঠিত ট্রেড ইউনিয়ন ছিল না,তার ভ্রূণ বলা যেতে পারে।

বলা যেতে পারে এ দেশে- শিল্প শ্রমিকদের প্রথম ঐতিহ্যশালী ধর্মঘট হলো -1862 সালের এপ্রিল মাসে হাওড়া স্টেশনে বারোশো রেল শ্রমিকের 8 ঘণ্টা কাজের দাবিতে ধর্মঘটে অংশগ্রহণ। রেলপথ স্থাপনের (1853 খ্রিস্টাব্দ) কয়েক বছরের মধ্যেই ঘটে যাওয়া এই ধর্মঘট গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই ধর্মঘট আমেরিকার শিকাগো শহরে 1886 খ্রিস্টাব্দে ঐতিহাসিক "মে দিবসের" আট ঘন্টা কাজের দাবীতে রক্তক্ষয়ী ঘটনাবলীর বহু পূর্বেই ঘটেছিল।সেই অর্থে ভারতে এই ধর্মঘটের ঘটনা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। মে দিবসের পূর্বে এই ধর্মঘট শ্রমিক শ্রেণীর সলতে পাকানোর কাজ হিসাবে সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ। 

বিশ্বজুড়ে শিকাগো শহরের শ্রমিকদের আট ঘণ্টার কাজের রক্তক্ষয়ী লড়াইকে স্মরণীয় করে রাখতে পয়লা মে "আন্তর্জাতিক মে দিবস" হিসাবে পালন করা হয়ে থাকে। 
আমাদের দেশে একক প্রচেষ্টা হিসেবে "প্রথম মে দিবস" পালিত হয় 1923 খ্রিস্টাব্দে। মাদ্রাজের সমুদ্র সৈকতে শ্রমিকনেতা- সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার।
মাদ্রাজে চেট্টিয়ারের সভাপতিত্বে 1923 সালে প্রথম মে দিবস পালন, শ্রমিক সমাবেশ ও রক্ত পতাকা উত্তোলন করা হয়।
লাল ঝান্ডা না থাকায় কমরেড চেট্টিয়ার সেদিন নিজের কন্যার লাল শাড়ি ছিঁড়ে তা দিয়ে লাল পতাকা তৈরি করে উড়িয়ে দিয়েছিলেন।

1929 সাল থেকে বিশ্ব মহামন্দা দেখা দিলে ভারতে ঔপনিবেশিক অর্থনীতিতে প্রবল সংকট দেখা দেয়। শ্রমজীবী জনগণের মধ্যে নেমে আসে চরম বেকারি, ছাঁটাই,মজুরি হ্রাস ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি জনিত আক্রমণ।
সংগ্রামের জীবন্ত প্রয়োজনীয়তা তখন একান্তই প্রয়োজন ছিল।
আমাদের দেশে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কাল পর্যন্ত ভারতীয় শ্রমিক শ্রেণী একদিকে নির্মম ব্রিটিশ শোষণের বিরুদ্ধে, অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তোলে। 
পরবর্তীকালে বিশ্বযুদ্ধের চরিত্র বদল হলে "জনযুদ্ধের" স্লোগান তোলা হয়, যা শ্রমিকশ্রেণীর বড় অংশকেই প্রভাবিত করেছিল। সাথে সাথে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবিও এই সময় তীব্র হয়ে ওঠে।
স্বাধীনতার প্রাক্কালে 1945,1946 সালে অস্বাভাবিক ভাবে ট্রেড ইউনিয়ন ধর্মঘট বৃদ্ধি পায়। নৌবিদ্রোহ,আজাদ হিন্দ বাহিনীর বিচার, যেকোনো ঘটনায় লড়াই-সংগ্রামে শ্রমিকশ্রেণীর অগ্রণী ভূমিকা ও নিয়ন্ত্রণ যথেষ্ট বেড়ে যায়।এই পরিস্থিতিতে সংগঠনের শক্তিতে স্থিতধী হয়ে বেঁধে চলেছে লড়াই সংগ্রামের নতুন নতুন সুর। সেই প্রেরনার ও অঙ্গীকারের পুনঃনবীকরন ঘটানোর সময় এসেছে আজ।করোনাউত্তর পৃথিবীকে 
বিকল্পের পথ দেখাবে শ্রমিক সংগঠনগুলি।গড়ে উঠবে শ্রমজীবীর বিশ্বভাতৃত্বের বন্ধন। 
দুনিয়ার মজদুর এক হও।

------------------------------
https://aipeuburdwan.blogspot.com

Post a Comment

0 Comments